সিঙ্গাপুরের সান্তোসা দ্বীপ এখন আলোচিত এক নাম। বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রতিদিনের খবরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন ১২ জুন এখানেই বৈঠকে বসছেন। সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে আধা কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপ অবকাশ যাপনে ও পর্যটনের জন্য বেশ জনপ্রিয়। এখানে রয়েছে বিখ্যাত থিম পার্ক ইউনিভার্সাল স্টুডিও। এ ছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ আর গলফ কোর্স। সান্তোসা ক্যাসিনোর জন্য বেশ বিখ্যাত।
কিন্তু এই দ্বীপের রয়েছে এক ভয়াবহ অতীত ইতিহাস।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনস্থ একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুরের আবির্ভাব ঘটে। এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত ও চীনের মধ্যকার নৌ–বাণিজ্যপথের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে সিঙ্গাপুর। বিবিসির খবর বলা হয়, ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগে থেকেই সিঙ্গাপুর উন্নত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, সেখানে ব্যবসায়ীরা হরহামেশাই আসা-যাওয়া করতেন। সেই সঙ্গে ছিল জলদস্যুদের উৎপাত। সেই থেকে সান্তোসা দ্বীপের অপর নাম যেন ‘মৃত্যুর দ্বীপ’ হয়ে ওঠে।
তবে ১৯৭২ সালের পর সিঙ্গাপুর সরকার এই কালিমা মুছে দ্বীপটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। নাম দেওয়া হয় সান্তোসা। যার অর্থ ‘শান্তি ও প্রশান্তি’। কিন্তু এই দ্বীপটি যেন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না।
১৯৮৩ সালে সাগরের ওপরে রোপওয়ে দিয়ে যাওয়া দুটি কেব্ল কারের সঙ্গে তেল খননকারী জাহাজের ধাক্কা লাগে। এতে দুটি কেব্ল কার সাগর পড়ে যায়। এ ছাড়া দ্বীপে একটি ফ্যান্টাসি আইল্যান্ড নামে ওয়াটার পার্ক খোলা হয়। কিন্তু ২০০০ সালে আট বছরের এক শিশু সেখানে পানিতে ডুবে মারা যায়। এরপর নিরাপত্তার অভিযোগে ২০০২ সালে পার্কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এতে দমে যায়নি সিঙ্গাপুর সরকার। ‘মজার রাজ্য’ হিসেবে আবার গড়ে তোলা হয় সান্তোসাকে। এখানকার ইউনিভার্সাল স্টুডিও থিম পার্ক, নতুন ওয়াটার পার্ক, রিসোর্ট, ক্যাসিনো, গলফ ক্লাবের আকর্ষণে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ছুট দেয় এই দ্বীপে।
এই দ্বীপে রয়েছে বিত্তশালীদের ঘরবাড়ি। এখানে এক একটি ভিলার দাম প্রায় তিন কোটি ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চলে হত্যাকাণ্ড
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জাপান এই দ্বীপকে দখল করে নেয়। তখন জাপানিরা এ দ্বীপকে ‘সায়োনান’, অর্থাৎ ‘দক্ষিণের বাতি’ নামে নতুন নামকরণ করে। তারপর এখানে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখানে থাকা সিঙ্গাপুরি চীনা লোকজনকে জাপানবিরোধীদের কর্মকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। পরিশোধনের নামে হাজারো মানুষকে তখন হত্যা করা হয়। যেসব জায়গায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয় তার মধ্যে বর্তমানে কেপেল্লা হোটেলের সামনে সমুদ্রসৈকত অন্যতম। এ ছাড়া জাপান ব্রিটিশ ও অস্ট্রিলিয়ান সৈন্যদের জন্য এই দ্বীপকে বন্দিশালা হিসেবেও ব্যবহার করে।
১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত থেকে মালয়েশিয়ার সঙ্গে মিলে মুক্তি পায় সিঙ্গাপুর। কিন্তু আদর্শিক বিভেদের কারণে দুই বছর পর মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে যাত্রা করে সিঙ্গাপুর।
কেপেল্লা হোটেলের হাল-হকিকত
কেপেল্লা নামের যে হোটেলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেটি শুধু বিশাল নয়, অতিকায়ও বলা যেতে পারে। কারণ, ৩০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা হোটেলের কামরার সংখ্যা ১১২। কামরাগুলো দক্ষিণ চীন সাগরের দিক মুখ করা। আর রয়েছে দুটি প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট। এই হোটেলে প্রতিটি কামরা ট্রাম্প-উন বৈঠকের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এই হোটেলে থেকে গেছেন ম্যাডোনা ও লেডি গাগা।
হোটেলটির সামনের অংশ খানিকটা পুরোনো গোছের, ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। কিন্তু এর অন্দরমহল বেশ আধুনিক। আর এই অন্দরমহল নির্মিত হয়েছে এশিয়ান আঙ্গিকে। বলা হয়, এখানে অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। হোটেলের নকশা এঁকেছেন ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট নোরম্যান ফস্টার।
এখানকার এক একটি কামরার ভাড়া শুরু হয় ৬৬৩ সিঙ্গাপুরি ডলার থেকে। আর তিন শোয়ার ঘরের কটেজ নিলে ভাড়া পড়বে প্রতি রাতের জন্য ১০ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার।
তবে এই বৈঠক উপলক্ষে এরই মধ্যে হোটেল সব বুকিং শেষ। ১৫ জুন পর্যন্ত কোনো কামরা ফাঁকা নেই।
হোটেল ঘিরে নিরাপত্তা
বৈঠকের জন্য কেপেল্লা হোটেলকে ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকার গেজেটে বলা হয়, ওই বিশেষ অঞ্চলে অস্ত্র, আগুন, উচ্চ শব্দ ও ব্যানার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি পুলিশের সন্দেহ হলে যে–কাউকে তল্লাশি করতে পারবে।
গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, এই দ্বীপটিকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা হলো, দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। ফলে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ। এখানকার বিশেষত্ব হলো নির্জনতা ও গোপনীয়তা। মূল দ্বীপের সঙ্গে এটি সড়ক, মোনোরেইল ও কেব্ল কারের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারে, তাই খুব সহজেই তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। বৈঠকের সময় দ্বীপটিকে ঘিরে থাকবে নিরাপত্তা বাহিনী। আকাশপথে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলেও সীমিত নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
সিঙ্গাপুরে গ্লোবাল ব্রোকিং সেন্টারের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ জুলিয়ান টেলর বলেন, হোটেলের চার পাশের ভূদৃশ্য এতটা পরিষ্কার, যেকোনো সমস্যা বা হুমকি খুবই সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। আর হোটেলের চৌহদ্দি এত বড় যে একটি ভবন থেকে অপরটি বিচ্ছিন্ন। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, তা হলো এখানে কোনো উঁচু ভবন নেই। ফলে ভবনের ওপর নজরদারির কোনো ঝুঁকি নেই।
- ব্রেকিংবিডিনিউজ২৪ / ০৯ জুন ২০১৮ / তানজিল আহমেদ